বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১ এর প্রতিপাদ্য ও কৃষির যত প্রণোদনা
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী
বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ফলে এক বহুমাত্রিক সংকটকাল অতিক্রম করছে সমগ্র বিশ্ব। দেশে দেশে খাদ্য ও পুুষ্টির অনিশ্চয়তাসহ নানাবিধ সমস্যা সঙ্কুল সময় অতিক্রম করছে বিশ্বের মানবসভ্যতা। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবর ২০২১ অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন অনুসরণপূর্বক সময়োপযোগী কর্মসূচি ও পরিকল্পনা যথাযথভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করার ফলে কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এমন কি করোনা সংকট মোকাবিলা করেও এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এ বছর বিশ্বখাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য মূলত কৃষিবান্ধব সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে ফসলের উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, লাভজনক কৃষি ও দক্ষ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। শুধু তাই নয়, জাতীয় কৃষি নীতির ৮ অনুচ্ছেদে- কৃষি পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা; ৯ অনুচ্ছেদে- বিশেষ আঞ্চলিক কৃষি; ১০ অনুচ্ছেদে- বিশেষায়িত কৃষি; ১১ অনুচ্ছেদে- নিরাপদ খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং ১৫ অনুচ্ছেদে- প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়ায় শুধু ২০২০-২১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কৃষি প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি তুলে ধরা হলো।
২০২০-২১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বমোট ৪৫৮,৮৭,১৯,৯৭৩/- টাকার (চারশত আটান্ন কোটি সাতাশি লাখ উনিশ হাজার নয়শত তিয়াত্তর) কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। উপকারভোগী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা ছিল মোট ৭৪,৪৯,৫৪১ জন (চুয়াত্তর লাখ ঊনপঞ্চাশ হাজার পাঁচশত একচল্লিশ)। মূলত গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা, কৃষক পরিবারের আয় বৃদ্ধি, কৃষি পরিবেশ সুরক্ষা, সর্বোপরি করোনা সংকট মোকাবিলা করে কৃষি অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়াসে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ অত্যন্ত সুচারুরূপে ও দক্ষতার সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালনা ও নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে উৎপাদন ও আয় বেড়েছে, পুষ্টি নিরাপত্তার অগ্রগতি হয়েছে, যা এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
রবি, খরিফ-১, খরিফ-২ এই তিন মৌসুমব্যাপী কৃষি প্রণোদনা/ কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। ২০২০-২১ বছরের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচিগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে কৃষি পুনর্বাসন কমিটির মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বিপুল সংখ্যক কৃষক/কৃষানির কাছে বিনামূল্যে সঠিক সময়ে কৃষি উপকরণগুলো পৌঁছে দেয়া হয়। ২০২০-২১ সালের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি সারণি দ্রষ্টব্য।
এ সকল কৃষি প্রণোদনা/কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা ছাড়াও আরো কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদেরকে নানাবিধ সহায়তা প্রদান করে কৃষি মন্ত্রণালয়। যেমন : ১) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় ঝড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি জেলায় ৪৮৬৬৫ জন কৃষক/ কৃষানিদেরকে ১৬,৩৬,৮৫,৫৫৫ টাকার অর্থ সহায়তা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট/মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। ২) করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৪% রেয়াতি সুদে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ৩) কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষক/কৃষানিদেরকে সমতলে ৫০% এবং হাওড় ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০% ভর্তুকিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ৪) সেচের ক্ষেত্রেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ৫) পতিত জমিতে সবজি চাষের জন্য প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বাড়ির অব্যবহৃত জমিতে ১০০টি করে পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হবে। এতে সারা দেশে সবজি, ফল ও মসলা জাতীয় ফসলের প্রায় পাঁচ লাখ পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপিত হবে। বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত এ সকল কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা দক্ষতার সাথে যথাসময়ে বাস্তবায়নের ফলে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বার্ষিক কর্মসম্পাদনে জাতীয়ভাবে ২য় স্থান অর্জন করেছে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে। এ সকল অগ্রগতি ও অর্জন ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার
কৃষি হবে দুর্বার।’
লেখক : সাবেক পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৫০১৪৯২, ই-মেইল : chakrobortykc@gmail.com